রাখিবন্ধনের বাঙালীয়ানায় এখনো ঐক্যের সুর

       ||রাজীব কুমার নন্দী||

“রামধনু মেঘ হৃদয়জুড়ে দুই চোখে নীল আকাশ নামে।
প্রানের রাখি পাঠায় কে রোজ
ভালোবাসার রঙ্গীন খামে।”
রাখিবন্ধনের সুরে বাঙালীর ঘরে ঘরে আজও শোনা যায় এই একই সুর।সময় পাল্টেছে,জীবন পাল্টেছে,বাঙালী আজও মজেআছে রাখিবন্ধন এর সুরে।ভাই বোনের চিরাচরিত মাঙ্গলিক শুভ মুহূর্তে বোনরা ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় রাখী বাঁধবে ভাইয়ের হাতে। আজ বাঙালীর উৎসবের সুর।বোন আর দিদিরা ধান,দূর্বা, প্রদীপ,মিষ্টি ও উপহারের থালা সাজিয়ে বসে আছে।।
রাখী বন্ধনের উৎসব নিয়ে আছে বিভিন্ন মত।
কীভাবে শুরু হয়েছিল এই রাখিবন্ধন উৎসব? নানা মুনির নানা মত। কাহিনিও রয়েছে অনেক। যার কয়েকটি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গল্প রয়েছে।
পৌরাণিক মতে-
যমুনা তাঁর ভাই যমের হাতে রাখি বেঁধেছিলেন।অন্যদিকে
শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদী— একবার কৃষ্ণের আঙুল কেটে গেলে, দ্রৌপদী তাঁর গায়ের কাপড় ছিঁড়ে তা বেঁধে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের আঙুলে। বদলে কৃষ্ণ কথা দেন, যে কোনও বিপদেই তিনি দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন।
অপরদিকে
লক্ষ্মী ও বানররাজ বালি— একবার এক হতদরিদ্র নারীর রূপ ধরে বালির কাছে আশ্রয় চান ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মী। বালি নিজের প্রাসাদের দরজা খুলে দেন তাঁর জন্য। খুশি হয়ে লক্ষ্মী, কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন বালির হাতে। দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের এক পূর্ণিমা।
ঐতিহাসিক মতে
হুমায়ুন ও রানি কর্ণবতী— শত্রুর হাত থেকে নিজের রাজ্যকে বাঁচাতে, মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে সাহায্য চান মেওয়ারের রানি কর্ণবতী। সেই সময়ে তিনি একটি রাখিও পাঠান হুমায়ুনকে।
অপরদিকে পুরু ও রোক্সানা— আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন পুরু। কিন্তু ইতিহাস বলছে, আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোক্সানা রাখি পাঠিয়েছিলেন পুরুকে। এবং তাঁর স্বামীকে হত্যা না করার আর্জিও জানিয়েছিলেন।
বাঙালীয়ানার ভাবনায় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর প্রচলন করেন এই রাখী বন্ধন উৎসব।মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধিতার পরিপেক্ষিতে এই উৎসব সূচনা।১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। ঐ বছরেরই ১৬ অক্টোবর (বাংলা মতে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আশ্বিন) থেকে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়। শ্রেণি বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল মানুষই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।ওই আন্দোলনে গঙ্গাঘাট পর্যন্ত তারা যাত্রা করেন ও গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর তারা একে অপরের হাতে রঙিন সুতো বেঁধে দেন। বাংলা তথা বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সংস্কৃতি, তাদের আশা আকাঙক্ষা তুলে ধরে গান লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন সারাদিনই কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা জুড়ে ঐ গানটি ধ্বনিত হতে থাকে-
“বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
সম্প্রীতির বার্তায় বিকশিত এই রাখী বন্ধন উৎসব করোনার আবহে কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে।তবু আশায় আছে বাঙালী।বোনেদের শুভ কামনায় ভাইয়েরা সুস্থ থাকবে সারাটা জীবন।যা এখন খুব জরুরী।তার সাথে ফিরবে ভাই বোনের রঙ্গীন খুনসুটি
তাই কবি চিত্তরঞ্জন দাস এর সুরে বলা যায়:-
“ভায়ের হাতে রঙ্গীন রাখি
যেই পরালো দিদি
ভাই বলে -হায় মিষ্টি তো নেই
এখন তোকে কি দি?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *